এলইডি বাতির ব্যবহার আমাদের চারপাশে এখন নিয়মিত। সস্তা ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হওয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তাও জুটেছে এর কপালে। পদার্থবিজ্ঞানে এবারের নোবেল পুরস্কারও আলোকিত হয়েছে নীল রঙের এলইডি বাতিতে। নীল এলইডির উদ্ভাবক তিন জাপানি বিজ্ঞানী শুজি নাকামুরা, সামু আকাসাকি ও হিরোশি আমানো পেয়েছেন ২০১৪ সালের নোবেল পুরস্কার। নোবেল জয় করা উদ্ভাবন নীল এলইডি নিয়ে এই প্রতিবেদন।
একটা দৃশ্যকল্পের কথা ভাবা যাক। মনে করুন বেশ বড় অফিসের বড় কর্তা আপনি। মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বাসায় ফেরেন। তো শখ হলো প্রিয় বান্ধবীকে একটা অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন উপহার দেওয়ার। টাকাভর্তি পকেটে গেলেন ঢাকার দামি শপিং মলে। বেশ কয়েকটা ফোন দেখতে দেখতে একটা পছন্দও হয়ে গেল। দুহাতে প্যান্টের দুপকেট বুঝে নিয়ে দোকানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দাম কত? দোকানির উত্তর, পাঁচ কোটি টাকা! দাম শুনে ততক্ষণে আপনার চোয়াল খুলে পড়ার দশা। বলে কী! হ্যাঁ, নীল রঙের এলইডি বাতি উদ্ভাবিত না হলে সবার পকেটে পকেটে স্মার্টফোন আর বাসার বিশাল পর্দার এলইডি টিভি বা ব্লু-রে ডিভিডি কোনোটাই সম্ভব হতো না। চলুন আজ এই নীল এলইডি (লাইট এমিটিং ডায়োড) বাতির গল্প শোনা যাক।
কমবেশি সবারই জানা, সূর্যের সাদা আলো আসলে সাতটি রঙের সমষ্টি। বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। কিন্তু এদের মধ্যে শুধু লাল, সবুজ ও নীলকে মিশিয়েই সাদা আলো তৈরি করা যায়। বিজ্ঞানের এই সহজ কারসাজিকে কাজে লাগিয়েই বানানো হয় হাল সময়ের স্মার্টফোন কিংবা টিভির পর্দা। যেখানে লাল, সবুজ ও নীল আলোর অনেকগুলো বাতিকে নানা সম্মিলনে (কম্বিনেশন) সাজিয়ে সাদা থেকে শুরু করে অন্যান্য যেকোনো রংই ফুটিয়ে তোলা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, বাতি তো অনেক ধরনেরই থাকে। ঠিক কোন ধরনের বাতি ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ খরচ হবে কম?
বিদ্যুৎ খরচের কথা বলছি কারণ প্রতিদিন বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, কলকারখানায় যত কাজে আমাদের বিদ্যুৎ খরচ হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই যায় আলোর পেছনে। এই যেমন হলুদ আলোদায়ী সেই আদিকালের ‘ইনক্যান্ডিসেন্ট বাতির’ কথাই ধরা যাক। বাল্বের ভেতরের ফিলামেন্ট তারে বিদ্যুৎপ্রবাহের ফলে অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে তা থেকে একসময় আলো বিকিরিত হতে থাকে। কিন্তু আলোর পাশাপাশি যে পরিমাণ তাপশক্তি এ থেকে বের হয়, তা কিন্তু আমাদের কোনো কাজেই আসে না। ফলাফল, মাস শেষে প্রচুর বিদ্যুৎ বিল। আর এ সমস্যা মেটাতেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে বসলেন নতুন একধরনের বাতি। নাম এলইডি বাতি। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এর কাজই হলো আলো বিকিরণ করা। এদের কিন্তু আগের মতো ফিলামেন্ট গরম করে আলো দিতে হয় না। এই এলইডি বাতিগুলো আসলে এক একটা p-n জাংশন সেমিকন্ডাক্টর। এখানে ইলেকট্রোনের বিভব শক্তি সরাসরি আলোতে পরিণত হয় বলে অন্য কোনোভাবে শক্তির অপচয় একেবারেই কম হয়। তাই এ ধরনের বাতিও অনেক সাশ্রয়ী। এ বাতি দিয়ে একই শক্তি খরচ করে ইনক্যান্ডিসেন্ট বাল্ব থেকে ১৬ গুণ বেশি আলো পাওয়া যায়। শুধু খরচই নয়, এলইডি বাতি টেকেও বহুদিন। প্রতিদিন গড়ে যদি চার ঘণ্টা করে এই বাতি জ্বালানো হয়, তবে ১৭ বছর ধরে একটি বাতি আলো দিতে পারবে।
সাশ্রয়ী ও টেকসই বলে তখন থেকে সবাই হুড়মুড় করে লেগে গেল এলইডি বাতি ব্যবহারের পেছনে। আর তখনই বাধল বিপত্তি। এলইডি বাতিতে ব্যবহৃত পদার্থ দিয়ে ইলেকট্রনের বিভব শক্তি বাড়িয়ে কমিয়ে লাল, হলুদ, সবুজ আলো তৈরি করা গেলেও নীল আলো কোনোভাবেই বের করা যাচ্ছিল না। কারণ, নীল আলো তৈরিতে সবচেয়ে বেশি শক্তির দরকার হয়। এ পরিমাণ বিভব শক্তির ইলেকট্রন যে পদার্থ থেকে পাওয়া যায় তা দিয়ে এলইডি বাতির মূল কাঠামো ঠিক স্থায়ী হয় না। আকারে বড় হলেও এলইডি বাতির মূল কাজের অংশ কিন্তু অনেক ছোট। এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। আর তাই একটা থালার মতো জায়গায় একসঙ্গে প্রায় এক হাজার এলইডি বানানো হয়। ফলে খরচ হয় কম, টেকেও বেশিদিন।
নীল রঙের এলইডি বাতি বানানোর জন্য যে পদার্থ উপযোগী, তা হলো গ্যালিয়াম নাইট্রাইড। জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসামু আকাসাকি, হিরোশি আমানো এই দুই বিজ্ঞানী নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অনেক খেঁটেখুঁটে এ পদার্থ দিয়ে নীল এলইডি বাতি বানানোর কৌশল বের করলেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই পদার্থ দিয়ে খুব বেশি এলইডি বাতি একসঙ্গে বানানো যায় না। খরচ কমাতে চাই একসঙ্গে থালার মতো যথেষ্ট বড় একটা স্ফটিক বা ক্রিস্টাল বানানো, যা কোনোভাবেই বিজ্ঞানীরা বের করতে পারছিলেন না।এবার এগিয়ে এলেন এক ছোট্ট ইলেকট্রনিকস কোম্পানির একজন প্রকৌশলী। নাম শুজি নাকামুরা, যিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা ক্যাম্পাসের অধ্যাপক। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা যেখানে ঘোষণা দিয়েছেন সস্তায় নীল এলইডি তৈরি করা সম্ভব না, তার তোয়াক্কা না করে তিনি অন্য দুই বিজ্ঞানীকে নিয়ে বানিয়ে ফেললেন খুব সস্তায় নীল এলইডি বাতি। এরপর প্রাথমিক এই তিনটি রং দিয়ে সাদা আলোর বাল্ব বানাতে আর কোনো বাধা রইল না। আর তখন থেকেই শুরু হলো নীল বাতির জয়জয়কার।
১৯৬২ সালে নিক হলনায়েকের হাত ধরে প্রথম এলইডি বাতির (লাল রঙের) জন্ম। পাঁচ বছর পরে জর্জ ক্র্যাফোর্ড উপহার দিলেন সবুজ এলইডি। আর নীল এলইডি এল ২৭ বছর পরে। সবাই যেখানে হাল ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানেই সামু আকাসাকি, হিরোশি আমানো ও শুজি নাকামুরা শেষ পর্যন্ত লেগে ছিলেন। তার ফলস্বরূপ বদলে গেল আজকের পৃথিবী। আর এই তিনজন বিজ্ঞানী এবার পদার্থবিজ্ঞানে অর্জন করলেন নোবেল পুরস্কার।
জন্ম: ২২ মে ১৯৫৪, ইকাতা, জাপান
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
কাজের ক্ষেত্র: সেমিকন্ডাক্টর শিল্প।
পুরস্কার: মিলেনিয়াম টেকনোলজি প্রাইজ (২০০৬), হারভে প্রাইজ (২০০৯) ও পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (২০১৪)।
হিরোশি আমানো
জন্ম: ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬০, হামামাৎসু, জাপান।
বর্তমানে জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত।
কাজের ক্ষেত্র: সেমিকন্ডাক্টর শিল্প।
পুরস্কার: পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (২০১৪)।
জন্ম: ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬০, হামামাৎসু, জাপান।
বর্তমানে জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত।
কাজের ক্ষেত্র: সেমিকন্ডাক্টর শিল্প।
পুরস্কার: পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (২০১৪)।
Post a Comment